'নুরু মামা চটপট এককাপ চা দেন তো!'
![]() |
শুভ্র অনুভূতি_মোহাম্মদ সম্রাট |
দিহান কাঠের একটা চিকন বেঞ্চিতে বসে পড়লো। শার্টের হাতা দিয়ে কপালে জমে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পানির বিন্দুগুলো মুছে ফেললো। আকাশটা সেই কখন থেকেই অন্ধকার হয়ে আছে! এবার নিশ্চয় টুপ করে বৃষ্টি পড়বে। মেঘের গর্জনে আশেপাশের গাড়িগুলোর হর্নও ঠিকমত শোনা যাচ্ছে না। কালো মেঘের আভায় কমলা সূর্যটা নিজেকে জানানও দিতে পারছে না!
দিহান চায়ের টঙে ঢুকার পরপরই মুষলধারে বর্ষণ শুরু হলো। বৃষ্টির কণাগুলো প্রতিনিয়ত মুখে ঝাপটা দিয়ে শিহরণ বয়ে দিচ্ছে। এই নিঝুম বর্ষণের দিনে মনটাও তার অজস্র স্মৃতির পাপড়ি মেলে ধরেছে। এক অস্বচ্ছ স্মৃতি তার চোখের পলকে ধীরে ধীরে স্পষ্টতর হলো।
দিহান নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইলো সেই প্রতিচ্ছবির দিকে। তার সুদীঘল, টানা টানা চোখের মায়ায় খুব করে ডুব দিতে ইচ্ছে করে। কাজলের আলতো ছোঁয়ায় মায়াটা আরো স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠলো তার চোখে।
মায়াবীপরীটা আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির অনুভুতিগুলোকে ছুঁয়ে দিচ্ছিলো। তার রূপালি শাড়ির আঁচল বেয়ে টুপটুপ করে বৃষ্টির ফোটাঁ ঝরছে। এই সূক্ষ্ম কলতান দিহানের মনে ভালোবাসার ঝর্ণাধারায় বয়ে চলেছে বারংবার। বৃষ্টির কণাগুলোর সুচারু নিক্ষেপে মায়াবী মুখটা আরো মায়াবী হয়ে উঠছে। ঠোঁটের কোণে গোলাপী রঙা হাসির অদ্ভুত মায়াজালে প্রতিনিয়ত আটকে যাচ্ছে দিহানের চোখজোড়া! মুখের সেই স্নিগ্ধ হাসির আবেশে দিহান ক্রমশ নিজেকে হারিয়ে ফেলছে সেই ভালোবাসার জলরাশির গভীরে, খুব গভীরে!
বোবা কণ্ঠে হাজারো আকুতি ঝরছিলো তার,
"হে সময়, তুমি একটু থেমে যাও! নাহ, আমি বেশিক্ষণ থামতে বলবো না শুধু এই মুহুর্তটাই থেমে যাও! আমার স্নিগ্ধ মায়াপরীটার হাসিতে একটু হারিয়ে যেতে দাও! সবসময়ের জন্যই আমাকে হারিয়ে যেতে দাও! প্লিজ-প্লিইইইইইইজ!!"
'ও দিহাম্মামা, চা তো ঠান্ডা হইয়া যাইতাছে। আফনে বৃষ্টির দিকা চাইয়া থাকতে থাকতে তো চা গুলান আর খাওনই যাইবো না!'
চা দোকানি নুরু মামার কণ্ঠে নিজের মাঝেই ফিরে এলো আবার।
'হুম, এই তো মামা এখন খাবো'
এই বলে মুচকি হাসলো সে। চায়ের কাপ থেকে বাষ্পগুলো সেই অনেকক্ষণ আগে মিলিয়ে গেছে। তবে গরম অনুভূতিটা এখনো হারিয়ে যায় নি! এক ঢোকে পুরো চা পান করে উঠে দাঁড়ালো দিহান।
'মামা কই যাইতাছেন। এহনো তো বিষ্টি থামে নাই।'
'নাহ, মামা। আসলে অনেকদিন বৃষ্টিতে ভিজতে পারিনি। তাই ভাবলাম, আজকে একটু বৃষ্টিতে ভিজে যাই'
'টিক আছে মামা, তবে বেশি দেরি করন যাইবো না। তাইলে ওসুখে পড়বা'
'হুম, মামা। আসি তাহলে; আসসালামু আলাইকুম।'
গাড়ির হেডলাইটের আলোয় পিচের রাস্তায় পানির বিন্দু চিকচিক করছে। গাড়ির আনাগোনাও তেমন নেই। মাঝে মধ্যে দু-একটি গাড়ি টায়ারে কর্কশ শব্দ তুলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। বৃষ্টির সূক্ষ্ম ছোঁয়া অনুভব করতে করতেই শার্টের স্লিভ খানিকটা গুটিয়ে নিলো; সেইসাথে কলারের বোতামটাও খুলে দিলো। বাতাসে হেলতে দুলতে থাকা চুলগুলো বৃষ্টির ছোঁয়ায় সামনে নুয়ে পড়েছে। ধীর গতিতে হাঁটছে দিহান। দিয়ামণিকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে প্রতিনিয়ত আনন্দে মেতে উঠছে সে। দিয়ার খুনসুটি গুলোকে বড্ড মিস করছে সে। দিয়ার আকুতিভরা কণ্ঠে ভালোবাসি শব্দটা শোনার পর থেকেই দিহান অন্যভূবনে পা দিয়েছিলো যেন! সময়গুলোও শরতের শুভ্র কাশফুলের মত বাতাসে দুলতে দুলতে পার হয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যেই দিহান ভীষণ রেগে গিয়ে দিয়াকে অনেক কথা শুনায়, দিয়া সমস্ত অগ্নিবাষ্প নীরবে সহ্য করেও ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসিটা ফুটিয়ে তোলে। কখনো মুখ ফুটে বলে না, তুমি আমাকে কষ্ট দিয়েছো! শুধু বলে, আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ; কক্ষনো আমাকে ছেড়ে যেও না! সত্যি দিয়ামণি বড়ই অদ্ভুত! মাঝে মাঝে কল্পনার আয়নায় দিয়ার দু-চোখের অভিমানী দৃষ্টি দিহানকে বড্ড নাড়া দেয়। দিয়ামণির মায়ার বাঁধনে নিজেকে জড়িয়ে স্বপ্নের পথে ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে দিহান। স্মৃতিচারণার ভিড়ে ঠোঁটে হঠাৎ নোনতা জলের উপস্থিতি পেয়ে চোখে হাত ছোঁয়ালো দিহান। চোখ দিয়ে ক্রমাগত জল গড়িয়ে পড়ছে। সেগুলো উপেক্ষা করেই টলমলে চোখে এগিয়ে চললো। থেকে থেকে বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে উঠছে সে। তবুও হাঁটা বন্ধ করলো না। কোন এক অদৃশ্য টানে সামনে এগিয়ে চলছে দিহান।
কিছুদূর গিয়ে একটি ফ্লাওয়ার শপে ঢুকলো সে। ফুলের মোঁ মোঁ ঘ্রাণে মনের আবছা কুঠিরে ধীরে ধীরে আলোর আভা স্পষ্ট হতে লাগলো।
দিয়া সাদা গোলাপ খুব ভালোবাসে। একটা সাদা গোলাপের তোঁড়া নিয়ে পুনরায় পথ চললো দিহান। গোলাপের শুভ্র পাপড়ি বেয়ে চুয়ে চুয়ে পানি পড়ছে। নাহ, ঠিক সাধারণ পানি নয় এ যেন বৃষ্টিরই ছন্দ!!
দিয়ার মাথাব্যাথাটা আগের চেয়ে অনেকটা কমেছে। তবুও ডাক্তারের পরামর্শে বেডে শুয়ে আছে সে। মাঝেমাঝেই তার কাঁপা কাঁপা চোখের পাপড়িগুলো প্রসারিত হয়ে মায়াবী মুক্তাদুটো চারদেয়ালের কেবিনের প্রতিটি কোণায় কাকে যেন খুঁজে বেড়ায়; খুঁজে না পেয়ে তার ক্লান্ত পাপড়িদ্বয়ের পরস্পরের আলিঙ্গনে আবার হারিয়ে যায় সে।
ধীরে ধীরে ঘুমের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে দিয়া।
ঠিক দুইদিন আগে, রাত প্রায় ৩ টার দিকে ফোনে দিয়ার বান্ধবী দিহানকে জানালো, দিয়া হঠাৎ ই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ফোনের অপরপাশের কথাগুলোর অনুভূতিতে তার পায়ের নিচের মাটিগুলো থরথর করে কাঁপছে। হতবিহ্বল মস্তিষ্ক বারংবার সংজ্ঞা হারানোর আপ্রাণ চেষ্টায় আছে তার! কাঁপা কণ্ঠে নিজেকে বলতে লাগলো,
"নাহ, আমার জ্ঞান হারালে চলবে না। আ--আমার দি-দিয়ার কিচ্ছু হয় নি। আ--আমি এখনই যাচ্ছি"
মেডিকেলে যতটা সম্ভব দ্রুত রওনা হয়েছে দিহান। মনে অজস্রবার প্রভুকে স্মরণ করছে সে! মেডিকেলে পৌছেই দ্রুত গতিতে দিয়ার কেবিনে গিয়ে ঢুকলো। তার ফ্যাকাসে মুখ দেখে ডাক্তার জানালো,
"Nothing worry my boy. তুমি একদম টেনশন করো না দিহান। দিয়ার ব্লাড প্রেশার বেড়ে গিয়েছিলো+ওর অক্সিজেন লেভেলটা ফল করেছে। আপাতত ২ টা দিন এখানে বিশ্রাম নিক; আমি ঔষধ প্রেসক্রাইব করে দিয়েছি; এগুলো ঠিক সময়ে খাওয়াবে ওকে আর যত্ন নিবে। Okay, Again I say; Please don’t worry, Everything will be sound soon."
সময় তখন রাত আটটা। মেঘের বর্ষণ তখন কিছুটা কমেছে; অনেকক্ষণ নিঝুম বৃষ্টির অজস্র রঙে মাখামাখি হয়ে দিহান এপ্রোন পরিধান করে কেবিনে ঢুকলো। হাতে সেই শুভ্র পুষ্পের তোঁড়া। ঘুমন্ত পরীটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে একটা চেয়ার নিয়ে দিয়ার পাশে বসলো দিহান। দিয়ার ডানহাতটি নিজের দু'হাতের বাঁধনে শক্ত করে ধরে রাখলো। হাতের তালুতে মেহেদীর ছোঁয়ায় একটি নাম লিখা!


দিহান ঘুমন্ত পরীটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। কণ্ঠে প্রচন্ড অনুনয় এর ঝড় তুললো সে-
"আমার দিয়ামণি, প্লিজ তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও। আবার আমাকে দিহু বলে ডাকো! এই দিয়া তাড়াতাড়ি উঠো, আমি তোমাকে রাগানোর জন্য সেই কখন থেকে অপেক্ষার প্রহর গুনছি। আমাকে মাইর দিবে না??!! অকেই, আমিও মন খারাপ করে বসে থাকবো। উঠবে না তো, উঠিয়ো না ঘুম থেকে; এবার তোমার সাথে আঁড়ি আঁড়ি!! আমার দুষ্টুপরী আমাকে ঘাবড়ে দিয়ে খুব মজা পাচ্ছো তাই না! হুম, তোমার মজা বের করবো। উঠো, উঠে যাও; অন্নেকগুলা চকলেট খাওয়াবো আমার দিয়ামণিকে!! উফফ, দিয়ামণি এখনো উঠে না, আচ্ছা বাবা; সরি সরি, আমি আমার দিয়ামণিকে একটুও মাইর দিবো না, বকুনিও দিবো না। শুধু একটু বুকে জড়িয়ে ধরে মনমেঘের বর্ষণ শুরু করবো। ওলে আমার দিয়ামণি, এখনো তোমার দিহুর উপর রাগ করে আছো। আচ্ছা রাগ করতে থাকো, কিন্তু তোমাকে একটুও ছেড়ে যাবো না। কক্ষনো না; কক্ষনোই না"
অশ্রু ফোঁটার ক্রমাগত বর্ষণে দিয়ার হাতের তালু ভিজে গেলো। দিয়ার হাতের তালুতে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিয়ে দৃঢ়ভাবে আটকে ধরলো হাতটি। বেশ কিছুক্ষণ দিয়ার হাতটি নিজের কপালে ঠেকিয়ে বসে ছিলো দিহান।
ধীরে ধীরে দিয়া নিজের মায়াবী মুক্তোরমণিতে দিহানকে অনুভব করলো। ঠোঁটের কোণে গোলাপী আভা পুনরায় ঝিলিক দিয়ে উঠছে তার।
'দিহু তু-তুমি কখন এলে??'
'এইত্তো আমার লক্ষ্মীটা চোখ খুলছে', দিহান আনন্দে ভাষা হারিয়ে ফেললো, 'আমি একটু আগেই এসেছি দিয়ামণি'
'দিহু আমার আর শুয়ে থাকতে ভাল্লাগছে না। আসো না একটু বৃষ্টিতে ভিজি!! প্লিজ!!'
দিহান পুনরায় হেলথ মনিটর করে সন্তুষ্টির হাসি হাসলো, 'হুম, যাওয়া যাক'
আর ফুলগুলো বাড়িয়ে দিলো দিয়ার দিকে।
" জানো, দিয়া ; সাদা সমস্ত রঙ এর সমাহার। এই শুভ্র ভালোবাসার রঙে বারবার রাঙিয়ে দিতে চাই আমার দিয়া পরীকে!"
দিহান উঠে দাঁড়াতেই দিয়া আচমকা তার গালে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে লজ্জারাঙা হয়ে গেলো। দিহানের বাম বাহু শক্ত করে জড়িয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে চলেছে সে। মেডিকেলের অদূরে শান্ত দীঘির পাড়ে সারি সারি বাঁধানো ঘাটের একটিতে বসে পড়লো দুইজনে। বৃষ্টির তেজ তখন অনেকটা কমে এসেছে। দিয়া দিহানের বাহু জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে একমনে বৃষ্টির ছন্দ উপভোগ করছে। দিহান হালকা গলায় গান ধরলো। দিয়া এবার চোখবন্ধ করে বাহুর বাঁধন শক্ত করে লক্ষ্মী মেয়ের মত চুপচাপ গান শুনছে। মাঝেমাঝেই দিহানের বাহুতে চিমটি কাটছে দিয়া। গান গাওয়ার মাঝেই মুচকি হেসে তাকালো সে।
'সারাজীবন এভাবেই আমার দিয়াপরী হয়ে থেকো! আমার দিয়ামণি, অন্নেকগুলা ভালোবাসি তোমাকে ; অন্নেএএএএএক!!'
গানের ও বৃষ্টির ছন্দে দুজনেই ক্রমশ জড়িয়ে গেলো গভীর ভালোবাসার বাহুডোরে।
☆শুভ্র অনুভূতি★
2 মন্তব্যসমূহ
Wow, very nice story!��
উত্তরমুছুনdhonnobad apnake.
মুছুন